আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ও উন্নয়নের দিক থেকে পৃথিবীর বর্তমান জনগোষ্ঠী মানব ইতিহাসের এক অসাধারণ সময় পার করছি, যা প্রায় কেউই বুঝতে পারছেন না। বর্তমান সময় এতোটাই অনন্য যে অতীতে মানবজাতি কখনোই এমন সময় পায়নি। ইন্টারনেট এবং আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা যে পরিমান তথ্য সংরক্ষণ এবং আদানপ্রদান করতে পারছি তা আজ থেকে মাত্র অর্ধশতাব্দী আগেও অনেকে কল্পনা করতে পারতো না। বর্তমানে শুধুমাত্র পৃথিবীর দুই প্রান্তের মানুষ সংযুক্ত নয়, বরং অসংখ্য বস্তু আমাদের সাথে এক অর্থে সংযুক্ত। আমরা বিভিন্ন বস্তু বা মেশিন থেকে তাৎক্ষণিক পেয়ে যাচ্ছি প্রয়োজনীয় তথ্য, যা মুহূর্তে পৃথিবীর সকল প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মার্কেটের তথ্য সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইওটি-অ্যানালিটিক্সের মতে ইতোমধ্যে সমগ্র পৃথিবীতে কানেক্টেড ডিভাইসের সংখ্যা ১৭ বিলিয়ন অতিক্রম করেছে, এবং এদের মাঝে শুধুমাত্র ইন্টারনেট অব থিংস এর ডিভাইসের সংখ্যাই প্রায় ৭ বিলিয়ন। আইওটি-অ্যানালিটিক্সের মতে, ২০২৫ সালের মাঝে কানেক্টেড ডিভাইসের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩৪ বিলিয়নে দাড়াবে।
আমরা এবং
আমাদের যুবসমাজ এক অবিশ্বাস্য সম্ভাবনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে, এমন সম্ভাবনা যা
আমাদের আগে কেউ কখনোই পায়নি। সংযুক্ত পৃথিবীর ফলে বিপুল পরিমান তথ্যের প্রবাহ
হচ্ছে, মানুষের চিন্তাকল্পনা, সৃজনশীলতা এক অনন্য পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আজ পৃথিবীর
ক্ষুদ্র এক প্রান্তের ঘটনাও নাড়া দিচ্ছে গোটা বিশ্বের বিবেকে। ছোট এক অঞ্চলের
ঘটনাও প্রভাব ফেলছে আন্তর্জাতিক ব্যবসাবাণিজ্য ও দেশের ভাবমূর্তিতে। এমন এক
সংযুক্ত বিশ্বের আগমন উপলদ্ধি করতে পেরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা
শেখ হাসিনা পরিকল্পনা করেছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার। উনার সেই সুদূরপ্রসারী
পরিকল্পনার কারনেই আমরা আজ এই দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার
স্বপ্ন দেখতে পারছি, সেই সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণেই আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে
বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে দাড়াতে পারছি।
গত ১০ বছরে
আমরা শান্তিপূর্ণভাবে যে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখেছি, তার ফলে বিভিন্ন খাতে আমাদের
সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশের অন্যতম বড় সম্পদ হলো আমাদের বিশাল
কর্মক্ষম যুব সমাজ, যা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও নেই। বর্তমানে আমাদের দেশে ২৫ বছর
থেকে ৫৪ বছর বয়সী মানুষের পরিমাণ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৯%, যেখানে জাপানের মত
উন্নত দেশের মোট জনসংখ্যার মাঝে বয়স্ক (৬৫ বা তার বেশি বয়সী) মানুষের পরিমাণ মোট
জনসংখ্যার প্রায় ২৭%। ২০৫০ সালে যেখানে জাপানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% মানুষ
বয়স্কদের তালিকায় থাকবে, তখন আমাদের দেশের বিশাল একটি অংশ যুবসমাজ হিসাবে দেশের
উন্নয়নে কাজ করে যেতে সক্ষম থাকবে।
[সুত্রঃ http://worldpopulationreview.com/countries/japan-population/]
এই ডিজিটাল
যুগে তরুণ সমাজকে যথার্থ সম্পদে পরিণত করতে, সহমর্মিতা ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর
সমাজ গড়তে জ্ঞান চর্চার কোন বিকল্প নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার মাধ্যমে দেশকে
এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, বেরিয়ে আসতে হবে অতীতের বর্বরতা থেকে। যারা কুসংস্কার, মিথ্যা
রটনা, গুজব ও ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে দেশে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে চায়, তাদেরকে
প্রতিরোধ করতে হবে। কারন এদেরকে প্রতিরোধ করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার
নেতৃত্বে উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে তা সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে না, বরং গোটা
বিশ্বের কাছে আমাদের এতোদিনের অর্জিত সুনাম ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
আমাদের
যুবসমাজকে আরোও কর্মক্ষম এবং প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের জন্য আরোও প্রস্তুত করে
গড়ে তোলার জন্য বর্তমান সরকার বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। একসময়ে
শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘ সেশনজট ছিল এক পরিচিত দৃশ্য। সেশনজটের কারণে সদ্য পাস করে
বের হওয়া তরুণদের জীবন থেকে ঝরে যেত বেশ কয়েক বছর, যা পরবর্তীতে তাদের কর্মজীবনেও
প্রভাব ফেলত। অনেক ক্ষেত্রে তিন থেকে পাচ বছর পর্যন্ত সেশন জট দেখা দিত। বর্তমান
সরকারের অধীনে সেশন জটের এই অভিশাপ থেকে আমাদের তরুণ সমাজ অনেকটাই মুক্তি পেয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন সেশন জট হচ্ছে না বললেই চলে। যার ফলে আমাদের তরুণ
সমাজ আরো কয়েক বছর আগেই শিক্ষা, গবেষণা এবং কর্মজীবনে অবদান রাখতে পারছে। যা
আমাদের জিডিপিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হচ্ছে
২৮টি হাইটেক পার্ক, যা আমাদেরকে প্রযুক্তিতে আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
এই হাই টেক পার্কগুলোর ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উন্নতমানের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার
দেশেই তৈরি করতে পারবে, যার ফলে বিদেশী বিনিয়োগ কারীদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি
দেশের তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
বর্তমান
সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের জন্য আজ আমরা প্রতিটিক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের সুযোগ সুবিধা
উপভোগ করছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া বা ফলাফল জানার জন্য অতীতে যে
ভোগান্তিতে পড়তে হতো তা আজ আর নেই। যোগাযোগ মাধ্যম আরোও উন্নত করার লক্ষ্যে তৈরি
করা হয়েছে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল
মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের দেশে চলে এসেছে ফোরজি ইন্টারনেট কানেকশন। খুব শীঘ্রই
ফাইভজি প্রযুক্তি দেশে নিয়ে আসার জন্যেও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। টিকেট বুকিং বা
ব্যাংক লেনদেনের মত কাজ আমরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেকোনো স্থান থেকেই করতে
সক্ষম হচ্ছি। স্বাস্থ্যখাত এবং তথ্য প্রবাহ ও সংরক্ষণে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া
এসেছে। যার ফলে দেশের কৃষক থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের সকল শ্রেণীর মানুষ সেবা
পাচ্ছে, সকলে উপকৃত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের পরিকল্পনাকে ধারণ করে আমাদের দেশ
আজ প্রযুক্তি নির্ভর এক দেশে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই কাজে অবদান রাখছেন
দেশের বিভিন্ন উদ্যোক্তা, গবেষক এবং শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে
উঠছে হাই-টেক পার্ক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে উঠছে উন্নতমানের গবেষণা কেন্দ্র।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হচ্ছে।
দেশের উন্নয়ন বজায় রাখার জন্য আমাদেরকে জনসম্পদকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি বিনিয়োগের প্রয়োজন। তবে শান্তিপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ বজায় রাখতে না পারলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশীরা এই দেশে বিনিয়োগ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সকলে মিলে সহিংসতা প্রতিরোধ করলে তবেই ডিজিটাল এবং দুর্নীতিমুক্ত, প্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ ও সুখী বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।সহিংসতাকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করলে আমরাই হয়ে উঠবো ডিজিটাল বাংলাদেশ।
লেখক: ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব
লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ