দুই সহপাঠীর অপঘাত মৃত্যুর প্রতিবাদে স্কুলের শিশুকিশোররা রাস্তায় নেমেছেরাস্তায় তারা শুধু শোক প্রকাশ করে থেমে থাকেনি - এরকম শোক যাতে ভবিষ্যতে কাউকে করতে না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা চায় তারাতারা নিরাপদসড়ক চায়সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তারা প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে শুধু তাই নয়, তারা নিজেরা এই ব্যবস্থাপনায় নেমে গিয়ে দেখাতে চেয়েছে যে, আইনের প্রয়োগের অভাবেই মূলত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছেতারাবাংলাদেশের মূল রোগটাকে সবার সামনে নিয়ে এসেছেতারা আইনের প্রয়োগ চায়যে প্রয়োগের নমুনা দেখানোর জন্য তারা গাড়ী চালকের লাইসেন্সের পেছনে লেগেছেফিটনেস সার্টিফিকেটের সন্ধানে লেগেছেআইনের প্রয়োগকরা যে সহজ বিষয় এবং সমাজে সবার সমর্থন পাবার বিষয়, সেটাও তারা দেখিয়ে দিলোযারা আইনের প্রয়োগকারী তারা নিজেরাই যে আইন মানছে না সেটাও তারা দেখিয়ে দিলোতা-ও কোনো বাহাদুরী করার জন্য নয়নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যআজ পর্যন্ত তাদের কারো মুখে বড়াই করতে শুনিনি, পত্রিকায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ গর্ব করে বলেনি যে আজ আমি এতজন লাইসেন্স বিহীন চালককে ধরতে পেরেছি

 

তাদের শৃংখলা দেখে হতবাক হয়েছিবালখিল্যতার লেশমাত্র নেই কোথাওপ্রগাঢ় পরিপক্কতার চিহ্ণ সর্বত্রবিভিন্ন স্থানে স্বতঃস্ফুর্তভাবে লেখা প্ল্যাকার্ডগুলি ইতিহাসে স্থান পাবার মততারা ম্যানেজমেন্ট থিউরির মূল প্রতিপাদ্যকেসম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে সুশৃংখলভাবে তাদের কাজ নিয়ে এগিয়ে গেছে নিজ নিজ উদ্যোগে, কেন্দ্রীয় কোনো উদ্যোগ ছাড়াতারা কোনো কমান্ড-কাঠামো তৈরী করেনি, কোনো কম্যুনিকেশান চ্যানেল স্থাপন করেনি, কোনো প্রশিক্ষণেরঅপেক্ষায় থাকেনি, নীতিমালা তৈরী করার প্রয়োজন বোধ করেনি, কোনো কনসালটেন্টের স্মরণাপন্ন হয়নিতারা তাদের মত করে সুশৃংখলভাবে একমনে কাজ করে গেছে

 

সরকার তার সমস্ত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এখন শিশুকিশোরদের হাত থেকে রাজপথ মুক্ত করার কাজে লেগেছে একনিষ্ঠভাবেসরকার একটা বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করে ফেললোরাজপথ মুক্তির অভিযানে না-গিয়ে সরকার সুন্দরভাবেশিশুকিশোরদের, তাদের বাবা-মাদের, দেশের সকল মানুষের ক্ষোভমুক্তির কাজে নামলে রাজপথও মুক্ত হতো, শিক্ষার্থীরাসহ সকল মানুষের বাহবা পেতোলাইসেন্সবিহীন চালক এবং ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন গাড়ী চিহ্ণিত করাকি এতই কঠিন কাজ?

 

রাস্তায় নামা শিশুকিশোরদের দেখে সবাই অভিভূত হয়েছেএই স্মৃতি জাতি কখনো ভুলবে নাতারা কান্নাকাটি করার জন্য বা শোকের মাতম করার জন্য রাস্তায় নামেনিতারা সমাধান নিয়ে নেমেছেঅত্যন্ত পরিচ্ছন্নতার সাথেনেমেছেসুশৃংখলতার সাথে তারা কাজ করে গেছেকোনো গলাবাজী ছিলো না, রাতব্যাপী নিজেদের মধ্যে বক্তব্য বা কর্তব্য স্থির করার জন্য বাকবিতন্ডা হবার কথা শুনিনিকারো মুখে এমন কোনো ভাব দেখিনি যাতে মনে হয়েছেযে, কিশোর কিশোরী অজানা কাজের দায়িত্ব পেয়েছে বলে কোনো অনিশ্চয়তায় ভুগছেতাকে যেখানেই যেকাজে দেখেছি মনে হয়েছে যেন একজন প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালন করেছেতার হাতে কোনো ওয়াকি-টকিনেই।  অস্ত্র নেইশুধু আছে বৃষ্টিতে ভেজা স্কুলের পোষাক, সারাদিন না খেতে পাওয়া শুকনা মুখ, পিঠে বইয়ের ব্যাগ

 

এরা কারা? এরা কোন গ্রহের বাসিন্দা? এরা কি আমাদেরই সন্তান? এরা কি আমাদের মেরুদন্ডহীন অস্তিত্বের পরিবেশে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্ম? বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় নাতাহলে কি আমাদের মেরুদন্ড আসলে হারিয়ে যায়নি? শুধুকৌশলগত কারণে লুকিয়ে রেখেছি? তাহলে কি আমাদের শিশুকিশোররা বড়দের এই মেরুদন্ড লুকানোর খেলাটা বুঝতে পারার আগেই মা-বাবার দেয়া আনকোড়া নতুন মজবুত মেরুদন্ড নিয়ে রাজপথে নেমে গেছে? তাদের দেখেচোখে আনন্দাশ্রু এসে পড়েনি এ-রকম মা-বাবা কি দেশে পাওয়া যাবে?

 

দুই

 

শিশুকিশোরদের রাস্তায় নামার পর থেকে আমার কাছে নানাজনে অনুরোধ পাঠাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন, কিছু উপদেশ দিন, তাদেরকে দিক-নির্দেশনা দিনআমি তাদের দিকে তাকালে বুঝে উঠতে পারিনা কী উপদেশ দেবো? পরে বুঝতে পারলাম কেন কোনো উপদেশ আমার মাথায় আসছে নাআমরা বড়রা তাদের উপদেশ দেবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিআমরা গর্তের ভেতর থাকা মানুষগর্তের ভেতরে থেকে উপদেশ দেয়া যায় না

 

তাদের প্রতি আমার একটাই পরামর্শতোমরা আমাদের উপদেশ শুনবে নাঅন্ধ মানুষ চক্ষুষ্মানকে চলার উপদেশ দিতে পারে নাতাদেরকে বলবো: তোমরা আমাদেরকে উপদেশ দেবার সুযোগ দিও নাযদি একবার এ সুযোগ দাওতাহলে তোমাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে আমাদের গর্তে না ঢোকানো পর্যন্ত আমরা আর থামবো না

 

আমরা এখন আর চোখে দেখি নাচোখের উপর একটা আস্তরণ টেনে দিয়েছি স্বেচ্ছায়নানা ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের এই ইচ্ছাকৃতভাবে না-দেখাটা যাতে ধরা না-পড়ে আমরা তার নিরন্তর প্রচেষ্ঠায় থাকিতোমরা আমাদের মতস্বেচ্ছাঅন্ধের কথায় কর্ণপাত করো নাকর্ণপাত করো না বলেই তোমরা রাস্তার দায়িত্ব নিতে পেরেছোযারা নিজেরা পথ চেনে না, তারা পথ দেখাবে কী করেআমাদের পরামর্শ নিলে তোমরাও গর্ত বানানোর কাজে লেগে যেতে

 

তোমরা পথ বের করেছোতোমরা তোমাদের পথেই থাকোতোমরা তোমাদের প্ল্যাকার্ডে অত্যন্ত সুন্দর করে তোমাদের সব কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়োছোতুমি বলেছ, “তুমি বাংলাদেশসেটাই সবচয়ে খাঁটি কথাঅন্য কোনোবাংলাদেশকে তুমি স্বীকার করো নাতোমার মত করে তুমি তোমার বাংলাদেশকে বানিয়ে নাওতুমি বলেছ: তুমি যদি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, তুমি যদি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশতুমি রুখে দাঁড়িয়েছ, তাই তুমিবাংলাদেশতুমি বলেছ: আমরা যদি না-জাগি মা, ক্যামনে সকাল হবেতোমরা জেগেছো, এবার সকাল হবেআমরা যারা চোখে দেখেও দেখিনা তাদের চোখের পর্দা এই ভোরের জ্বলন্ত আলো দিয়ে কেটে দাওআমাদেরকেতোমাদের সঙ্গে থাকার উপযুক্ত করে নাওতুমি যেমন বাংলাদেশ, আমাকে তোমার মত করে বাংলাদেশ হবার মতো উপযুক্ত করে নাও

 

গর্তে গুঁজে থাকা আমাদের শীতল নিস্তেজ শরীরে তোমারা আগুন ছড়িয়ে দাওযদি আগুনের কোনো ছিটেফোঁটা আমাদের শরীরে এবং মনে এখনো থেকে থাকে, তবে হয়তো তোমার আগুনে সেটা আবার উত্তাপ ফিরে পাবে

 

তোমরা রাতের অন্ধকার থেকে জ্বলন্ত সকালকে টেনে বের করে আনার ব্রতে নেমেছোতোমরাই পারবে আমাদের হিমশীতল অস্তিত্ব থেকে টগবগে বাংলাদেশকে বের করে আনতে

তুমিই বাংলাদেশ!

তোমার চোখেই দেখতে চাই বাংলাদেশকেতোমার মনের রং মেখে রাঙিয়ে দিতে চাই আমাদের মনগুলিকে