যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাসরত ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপকে বলা হয় ‘ম্যাজিকম্যান’। তার প্রতিষ্ঠিত পিপল এন টেক-এর মাধ্যমে প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশিকে আমেরিকায় মিড লেবেল কিংবা সিনিয়র লেবেলের চাকরি দিয়েছেন। অড জব কিংবা এন্ট্রি লেবেলের জব থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এবার তিনি দায়িত্ব নিলেন আইগ্লোবাল ইউনিভার্সিটির। এটি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রি এবং একাডেমির মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোর স্বপ্ন দেখছেন আবুবকর হানিপ।
কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসের অংশ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাসরত ‘ম্যাজিকম্যান’ খ্যাত ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ। বাংলাদেশি মার্কিনি হিসেবে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা অর্জন করেন তিনি।
এ বছরের শুরুর দিকে ভার্জিনিয়া স্টেটের ভিয়েনায় অবস্থিত ‘আই গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি’ (ইনোভেটিভ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি তথা আইজিইউ)-এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান, ব্যবসা ও প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ যুক্তরাষ্ট্রে ‘পিপল এন টেক’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে মার্কিন আইটি সেক্টরে গত দেড় দশকে ৭ হাজারের অধিক প্রবাসীকে উচ্চ বেতনে চাকরির ব্যবস্থা করেন ইঞ্জিনিয়ার হানিপ। পিপল এন টেকের কারণে হানিপ প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে দারুণ সমাদৃত। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি রীতিমতো সবাইকে চমকে দিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাও বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিমধ্যে কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। জানা গেছে, গত ১২ বছরে ৪ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ শতাধিক। এর মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। প্রকৌশলী আবুবকর হানিপ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা-পর্ষদের প্রধান এবং মালিকানায় আসার পর শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এনে সব ডিগ্রিধারীকে উপযুক্ত চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সহায়তা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। পিপল এন টেকের পর কেন এই উদ্যোগ? এ বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন হানিপ।
তিনি বলেন, ‘পিপল এন টেক এ আমরা মূলত অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত মানুষের স্কিল ডেভেলপের কাজ করে থাকি। কিন্তু উচ্চ ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও অনেকে ভালো চাকরি পেতে পারেন না। উচ্চ বেতনে চাকরি পাওয়ার জন্য আপনার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু কেবল ডিগ্রিই আপনাকে চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। যেমনটা আমাকে দেয়নি ২০ বছর আগে। বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি থাকার পরও আমি এখানে স্বল্প পারিশ্রমিকের কাজ, অর্থাৎ ‘অডজব’ করতাম। সে সময় আমি অনুভব করেছি আমার এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি থাকলে হয়তো আমি উঁচু মানের এবং অনেক বেশি বেতনের চাকরি পাব।’ নিজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই যুক্তরাষ্ট্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন হানিপ। সেই কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘প্রায় ৫০ হাজার ডলার ঋণ নিয়ে আমি কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করলাম। সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে আমি পাস করার পরও সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পাইনি। ফের ফিরে গেলাম অডজবে, জীবন চালিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে। কিন্তু আমি থেমে যাইনি, হতাশও হইনি। বেশ কিছুদিন পরে আমি ঠিকই আইটি জবে ঢুকতে পেরেছি স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং সম্পন্ন করে। তখন আমি বুঝলাম, ডিগ্রি দরকার, কিন্তু শুধু ডিগ্রি দিয়ে একজন তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে না। স্কিল ডেভেলপমেন্ট ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়। সেই মানসেই আমি ১৫ বছর আগে ‘পিপল এন টেক’ নামক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করি, যার মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার অভিবাসী এখন উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন। ‘সেই পিপল এন টেক’র অভিজ্ঞতাই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এতদিন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সে স্বপ্ন এখন পূরণ হলো। আমি এবং ভার্সিটি টিম বেশ গর্ব করেই বলতে পারছি, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমরা ক্যারিয়ার সহায়তা দেব। কেননা সেই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা সুবিধাদি আমরা এরই মধ্যে অর্জন করেছি ‘পিপল এন টেক’র মাধ্যমে। আর এজন্যই আমাদের শিক্ষকরা শুধু স্কলার নন, তারা ইন্ডাস্ট্রি প্র্যাকটিশনারও, যাদের রয়েছে চার থেকে ৩০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা।’
আবুবকর হানিপ জানান, ‘একজন অভিবাসী যেমন তার দেশের ডিগ্রি নিয়ে এসে এখানে পুনরায় ভার্সিটিতে পড়াশোনা শেষ করতে হয়। ব্যাচেলর ডিগ্রি কিংবা মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেও এন্ট্রি লেবেলের চাকরি করতে হয়। তখন একজন কোয়ালিফাইড ও এডুকেটেড ছাত্রও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। আবার অনেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়েও চাকরি করে পুলিশে কিংবা ভিন্ন পেশায়। যেখানে তার শিক্ষা খুব একটা কাজে লাগে না। মূলত এই পয়েন্টটাতেই কাজ করবে আইগ্লোবাল ইউনিভার্সিটি। এই ইউনিভার্সিটি শুরু থেকেই ডিগ্রির পাশাপাশি স্কিল ডেভেলপমেন্টের কাজ করে। যাতে করে ডিগ্রি সম্পাদনের পর কেউ চাকরির জন্য বসে না থাকে কিংবা বাধ্য হয়ে এন্ট্রি লেবেল কিংবা অড জব না করে। মূলত ইন্ডাস্ট্রি এবং একাডেমির মধ্যে একটা ইকোসিস্টেম তৈরি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের এখান থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পর যেন কারও চাকরির অভাব না হয়।’
আবুবকর হানিপ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে রেমিট্যান্স, গার্মেন্টস ও এগ্রিকালচার। কিন্তু ইনফরমেশন টেকনোলজিও (আইটি) দেশের অর্থনৈতিক চেহারা আরও দ্রত পাল্টে দিতে সক্ষম। এ জন্য বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে সঠিক আইটি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
এ বছরের শুরুর দিকে ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি টাকার শিক্ষা বৃত্তি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে ড. আবদুল মোমেনের নামে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পর্যায়ে দুটি স্কলারশিপও দেওয়া হবে। এই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করা যাবেwww.igu.edu ওয়েবসাইটে।
বাংলাদেশিদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সুযোগ সুবিধা থাকবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ। নিজেকে আপাদমস্তক বাঙালি দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। এই দেশের মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা সব সময় করি। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা প্রাধান্য পাবে। এর মধ্যেই স্কলারশিপ ঘোষণা করা হয়েছে। সামনে আরও ঘোষণা আসবে।’
সুযোগ থাকলে আর সরকার চাইলে বাংলাদেশেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা চালুর ব্যাপারে ইচ্ছাপ্রকাশ করেন আবুবকর হানিপ। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেও প্রতিমুহূর্তে বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা মানুষটি সফল হবেন, এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার।