করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে, যা বিশ্বের মোট মৃতের সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। দুই দশক ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যত না আমেরিকান মারা গিয়েছিল, গত ছয় সপ্তাহে একটি অদৃশ্য ভাইরাসে তার চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে সেদেশে।

আর যত বেশি বেশি মৃত্যু হচ্ছে, চীনের প্রতি আক্রমণের ভাষা ততই শাণিত করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার রাজনৈতিক মিত্ররা।

তাদের কথা - ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের শুরুতে চীন তা গোপন করেছে বলেই এই প্যানডেমিক, এবং এর দায় চীনকে নিতে হবে।

দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, চীন এই প্যানডেমিকের জন্য কতটা দায়ী যুক্তরাষ্ট্র তা তদন্ত করবে।

গতকাল (বুধবার) রয়টার্স বার্তা সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চীন তাকে নভেম্বরের নির্বাচনে হারানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। "তারা (বেইজিং) সবকিছু করবে।"

শুধু আমেরিকা নয়, অস্ট্রেলিয়ার ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন গতকাল (বুধবার) করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের কথা বলেছেন যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেইজিংয়ে।

ইউরোপীয় দেশগুলো এখনও ততটা স্পষ্ট করে চীনকে নিয়ে কিছু বলছে না, তবে সন্দেহ নেই যে বাদানুবাদ যত বাড়বে, মেরুকরণও বাড়বে।


নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন ট্রাম্প

কিন্তু এই সঙ্কটের মাঝে কেন চীনকে নিয়ে এতটা পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ?

অনেক পর্যবেক্ষক এর পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দেখছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির সংবাদদাতা ডেভিড উইলিস বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলতে চেয়েছেন যে, চীন উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ভাইরাসের কথা অনেকদিন চেপে রেখেছিল যাতে এর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি হেরে যান।

মার্কিন পত্র-পত্রিকায় খবর বের হতে শুরু করেছে, যেভাবে সরকার করোনাভাইরাস সামলাচ্ছ তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ-অসন্তোষ তৈরি হয়েছে যার প্রভাব নির্বাচনে পড়তে বাধ্য।

অর্থনীতি, কাজের সুযোগ বাড়ানোই ছিল মি. ট্রাম্পের রাজনীতির মুখ্য শক্তি, কিন্তু করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্দশা নির্বাচনের বছরে তাকে কোণঠাসা করে ফেলছে।

চীন তাকে নির্বাচনে হারাতে চাইছে এই কথা বলার দিনই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরীণ একটি নির্বাচনী জরিপ নিয়ে তার পরামর্শকদের বেশ গালমন্দ করেন বলে জানা গেছে।

ঐ জরিপে বলা হয়েছে, ফ্লোরিডা, উইসকনসিন বা অ্যারিজোনার মত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে জেতা মি. ট্রাম্পের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।


'করোনাভাইরাস মোক্ষম সুযোগ'

তবে কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে চীনকে কম-বেশি ইস্যু করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যে কোন অজুহাতে চীনকে ঘায়েল করা এখন আমেরিকার জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তিনি বলেন, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) গ্রহণ করে, সেখানে চীনকে তারা তাদের প্রধান শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

"যে কোন সুযোগেই চীনকে কোণঠাসা করা, দুর্বল করার চেষ্টা এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীনে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ওয়াশিংটনকে নতুন আরেকটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছে।"

ড. আলী বলেন , সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নেয়, তাতে পরিষ্কার বলা আছে, আর কোনদিনই বিশ্বের কোথাও তারা এমন কোন শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেবে না যারা আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

"অনেকদিন ধরেই চীনকে তারা ভবিষ্যতে সেই ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছে।"

"বিশেষ করে এখন আমেরিকান প্রশাসনের মধ্যে এমন একটি আশঙ্কা হয়তো দেখা দিয়েছে যে কোভিড-১৯ প্যানডেমিক মোকাবেলায় তাদের দুর্বলতা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে বিশ্বের কাছে তাদের মর্যাদা, প্রতিপত্তি আরো ক্ষুণ্ণ হবে, এবং সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে চীন।"

কিন্তু মৌখিক যুদ্ধ ছাড়া চীনকে আর কীভাবে শায়েস্তা করতে পারে আমেরিকা?

ড মাহমুদ আলী মনে করেন, আমেরিকা তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সাথে নিয়ে চীনকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে একঘরে করার চেষ্টা করতে পারে।

আর সেই সাথে সামরিক শক্তির মহড়া দেখিয়ে বেইজিংয়ের ওপর স্নায়ু চাপ বাড়ানোর পথও যে আমেরিকা নিতে পারে তার লক্ষণ এ সপ্তাহেই দেখা গেছে।


চীন কীভাবে চাপ সামালাবে?

ড. আলী মনে করেন, কূটনীতিই এখন চীনের কাছে সর্বোত্তম উপায়।

জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বহুজাতিক ফোরামকে ব্যবহার করে বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোকে সাথে নিয়ে একটা কূটনৈতিক জোট তৈরির পথে যেতে পারে চীন। তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের সাথে ৬০টিরও বেশি দেশ রয়েছে, যাদের সাথে এই কূটনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করতে পারে চীন।

"তবে চাপের কাছে নতি স্বীকারের মত কোন কিছু আমরা দেখবো না। চীনের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে আমি একটি মনোভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করছি যে তারা বাইরের কোন চাপ আর মেনে নিতে রাজি নন।"

সাম্প্রতিক সময়ে চীনা কূটনীতিকরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।

তারা খোলাখুলি বলছেন, আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সময়মত ব্যবস্থা নেয়নি এবং সেই ব্যর্থতার দায় চীনের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।

চীনের সরকারি বার্তা সংস্থা ৬ই এপ্রিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সরকারের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপের একটি টাইমলাইন প্রকাশ করেছে। সেটা দেখিয়ে চীনা সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কোন কিছুই গোপন করা হয়নি।

চীনের সরকারপন্থী দৈনিক 'চায়না ডেইলি' তাদের এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, "অনর্থক চীনকে দোষারোপ করা বন্ধ করতে হবে আমেরিকাকে। একটি প্যানডেমিক নিয়ে রাজনীতি করলে মানুষের প্রাণহানি বাড়বে ছাড়া অন্য কোন লাভ হবেনা।"


বদলে যাবে বিশ্ব বাণিজ্য

তবে লন্ডনে অর্থনীতিবিদ ড. মুশতাক খান মনে করছেন, করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের পরিণতিতে ভবিষ্যতে চীনের ওপর পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা যে কমবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

"চীন ভাইরাসের কথা গোপন রাখুক আর নাই রাখুক সেটা অন্য বিতর্ক, কিন্তু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের অর্থনীতি যে একটা চাপে পড়তে চলেছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।"

গত কয়েক দশকে পশ্চিমের দেশগুলো তাদের অনেক অতি-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্যও চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

ড. খান মনে করেন, বর্তমান সঙ্কট কেটে গিয়ে অর্থনীতি সচল হওয়া শুরু হলে তখন অনেক দেশই চীনের বদলে অনেক কিছুই নিজেরাই উৎপাদনের পথে যাবে।

"অন্তত তারা তাদের সরবরাহের জন্য শুধু চীনের ওপর ভরসা করবে না। আরো বিকল্প সূত্রের খোঁজ করতে শুরু করবে,'' তিনি বলেন।

চীনের জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশই আসে বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে। চীন সেখানে বড় ধরণের ধাক্কা খাবে বলে মনে করেন ড. খান।

"এই সঙ্কটের পর পৃথিবী যেভাবে চলছিল সেভাবে যে আর চলবে না সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি। চীনকে সেই বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এখনকার মত তাদের প্রবৃদ্ধি হয়তো আট শতাংশ হবে না, হবে পাঁচ শতাংশ।"

করোনাভাইরাস সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এই রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক সঙ্কট চীন কীভাবে মোকাবেলার চেষ্টা করবে, তা হয়তো কিছুটা স্পষ্ট হবে যখন ২২শে মে চীনের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের সভা শুরু হবে। বিবিসি