শুরুটা হয়েছিল মেক্সিকান ইয়াম থেকে। ১৯৪২ সালে পেনসিলভানিয়ার একজন রসায়নের প্রফেসর প্রোজেস্টেরনের সহজলভ্য উৎস খুঁজছিলেন। প্রোজেস্টেরন তখন গর্ভপাত ও মাসিকসংক্রান্ত জটিলতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো।

প্রফেসর রাসেল মার্কার কিছু গাছপালা থেকে প্রোজেস্টেরন তৈরির পদ্ধতি বের করেছিলেন। এসব গাছগাছড়ার মধ্যে একটি ছিল জাপানি বুনো ইয়ামের শিকড়। কিন্তু এগুলো খুব সরু হওয়ার এ থেকে খুব বেশি হরমোন পাওয়া যেত না।

বিকল্প খুঁজতে লাগলেন মার্কার, চার শর বেশি প্রজাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন, কিন্তু পেলেন না। এরপর তিনি পুরোনো একটি উদ্ভিদবিদ্যার বইয়ে ইয়ামের ছবি খুঁজে পান। ওই ইয়ামের মোটা, গাঁটযুক্ত শিকড় হতো। শিকড়গুলোর ওজন হতো ১০০ কেজির কাছাকাছি। এর সন্ধানে তিনি মেক্সিকো যান এবং সেখান থেকে ওই ইয়াম নিয়ে আসেন।

প্রোজেস্টেরনের সহজলভ্য উৎস খুঁজে পাওয়ার পর গবেষকেরা এটিকে জন্মনিরোধক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এক দশকেরও কম সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু মার্কার রহস্যজনকভাবে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান এবং তিনি রুপা সংগ্রহের কাজে মন দেন।

জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ির জয়জয়কার পড়ে যায় এরপর থেকে। কেননা, এটি খেলে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ভয় ছাড়াই যৌনতা উপভোগ করা যায়। ২০ এবং ৩০-পরবর্তী নারীরা এখন পড়াশোনা ও পেশাগত উৎকর্ষের জন্য সময় দিতে পারেন। তাঁদের শুধু গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় না।

কিন্তু শুরু থেকেই জন্মনিরোধক বড়ির একটি ব্যাপার খুব গোপনীয় থাকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করতে পারছেন, বড়ি খাওয়া নারীদের মস্তিষ্ক না-খাওয়াদের তুলনায় অন্য রকম—খানিকটা পুরুষালি। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের আচরণও আলাদা।

নির্দিষ্ট ধরনের বড়ি খাওয়া নারীদের অনেকেই কথা বলার সময় সঠিক শব্দটি খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন। আবার তাঁরা বিভিন্ন চলমান বস্তুর পরীক্ষায় ভালো করেন, যেটা আসলে পুরুষদের বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, নানা ধরনের বড়ি খাওয়া নারীরা কারও মুখ মনে রাখার ব্যাপারে ভালো হন, যেটাতে মেয়েরা এমনিতেই ভালো।

বিভ্রান্ত? খোদ বিজ্ঞানীরাই এ নিয়ে বিভ্রান্ত। হচ্ছেটা কী?

আমরা প্রায়ই বলি, জন্মনিরোধক বড়িতে অস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন আছে। কিন্তু কোনো বড়িতেই হরমোন নেই।

কেননা, যখন আমরা সেটা গিলে খাই, দ্রুতই অস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন ভেঙে যায়। পরিবর্তে কিছু কিছু বড়ির সিনথেটিক ভার্সন আছে, যেগুলো আরও বেশি স্থিতিশীল হরমোন দিয়ে তৈরি।

বাজারে থাকা কম্বাইন্ড বড়ির প্রতিটি ব্র্যান্ডেই একই ধরনের সিনথেটিক অস্ট্রোজেন, ইথিনিল এস্ট্রাডিওল ও আট সিনথেটিক প্রোজেস্টেরনের একটি, যাকে বলা হয় প্রজেস্টিন, আছে। ইথিনিল এস্ট্রাডিওল প্রতি মাসে শরীরে ডিম্বাণু তৈরি হতে বাধা দেয়।

এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। যদিও হরমোন আমাদের জন্মপ্রক্রিয়ায় বাধা দেয়, এরা কিন্তু আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক হরমোনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে এসব সিনথেটিক হরমোনের প্রতিক্রিয়া প্রাকৃতিক হরমোনের মতো নয়।

বড়ি খাওয়ার পর ব্রণের সমস্যা, ঘাম ও অবাঞ্ছিত লোম ওঠার খবরে ইন্টারনেট ভাসছে। এক নারী তাঁর সারা গালে লোম উঠে ভরে যাওয়ার কথা লিখেছেন। আরেকজন নতুন ব্র্যান্ডের পিল খাওয়া শুরু করার পর তাঁর ‘পিৎজাকৃতির’ মুখের কথা লিখেছেন। বিজ্ঞানীরাও কিন্তু পিল খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব পুরুষালি লক্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের পিল নারীদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


২০১২ সালের এক গবেষণা জানাচ্ছে, আমেরিকার জন্মনিরোধক বড়ি গ্রহণকারী নারীদের ৮৩ শতাংশ এমন ধরনের পিল খাচ্ছে, যেটিতে পুরুষ হরমোন থেকে তৈরি প্রজেস্টিন রয়েছে। প্রজেস্টিন হলো নানড্রলোন নামক একধরনের টেস্টোস্টেরন। এটি নারীদের মধ্যে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির জন্য দায়ী।

অস্ট্রিয়ার সালজবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী বেলিন্ডা প্লিৎজার বলেন, ‘এটি (হরমোন) আসলে মাঝে মাঝে পুরুষদের ডোপিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়।’ এটি মাংসপেশি তৈরিতে সাহায্য করে। এ কারণে এটি ভারোত্তোলক ও মুষ্টিযোদ্ধাদের কাছে জনপ্রিয়। ২০১৫ সালে স্টেরয়েড পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল আসায় সাবেক হেভিওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মুষ্টিযোদ্ধা টাইসন ফারি দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার শাস্তি ভোগ করছেন।

জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি ব্যবহারের আগে তাই জেনে নেওয়া ভালো, বড়িটা কী কী উপাদান দিয়ে তৈরি।

 

বিবিসি অবলম্বনে

বিডি/ ইব্রা