বিগত দিনের সব রেকর্ড ভেঙে এ পর্যন্ত দেশে প্রায় ১১ হাজাররের ও বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকার বাইরে। এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ৬১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৪২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সরকারি হিসেবে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৪ জন মারা গেছেন। তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা হবে ৩১ জন।

সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, রাজধানীতে ব্যাপক হারে ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। তবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পেলেও এডিস মশা মারার কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদ্বয় ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ওপর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী।

রাজধানীর সরকারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হওয়ার কারণে তাদের অধিকাংশকে এখন আর শয্যায় রেখে চিকিত্সা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শয্যার অভাবে ভর্তিকৃত ডেঙ্গু রোগীদের কাউকে ওয়ার্ডের বারান্দায়, আবার কাউকে সিঁড়ির পাশে রেখে প্রয়োজনীয় চিকিত্সা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সরেজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, মেডিসিন ও শিশু ওয়ার্ডের ফ্লোর, বারান্দা এমনকি সিঁড়ির পাশে ডেঙ্গু রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। পা রাখার জায়গা নেই ওয়ার্ডে। এক বেডে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত পাঁচ শিশুকে রেখে চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের দেখভাল করার জন্য কর্তব্যরত নার্সরা দৌড়ঝাঁপ করছেন। চিকিত্সকদের লিখে দেওয়া ব্যবস্থাপত্র দেখে ব্লাড প্রেসার মাপা, প্লাটিলেট কমছে না বাড়ছে তা দেখা, শিরায় স্যালাইন দেওয়া ও পানীয় খেতে সাহায্য করাসহ নিবিড় সেবা প্রদান করছেন তারা। বিরামহীনভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্সরা।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর সঙ্গে আসা উদ্বিগ্ন স্বজনদের উপস্থিতির কারণে চিকিত্সাসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানিয়েছন চিকিত্সক ও নার্সরা। নিরাপত্তারক্ষীরা স্বজনদের রোগীর পাশ থেকে সরে যাওয়ার কথা বললেও তারা যাচ্ছে না। এই অবস্থা শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়, রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মুগদা, ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ সব হাসপাতালেই দেখা গেছে।

এদিকে ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মনোপলি বাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ডেঙ্গুর রক্ত পরীক্ষা ফি ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যার পূর্ব মূল্য ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা। এছাড়া আরো অন্যভাবে ডেঙ্গু রোগীর কাছ থেকে রক্ত পরীক্ষার নামে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। গতকাল রবিবার রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ মোকাবিলায় প্রাইভেট হাসপাতাল/ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর পরিচালক/ ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ‘ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সা সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে স্বাস্থ্য ভবনের সম্মেলন কক্ষে এ সভায় ডেঙ্গু রোগীর রক্ত পরীক্ষা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এই মূল্য তালিকা গতকাল রবিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এই মূল্য তালিকা কার্যকর থাকবে। আর সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষা বিনামূল্যে হচ্ছে।

এডিস মশামুক্ত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের পুরস্কৃত করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর আজিমপুর দক্ষিণ কলোনি মাঠে মশক নিধন কর্মসূচি উদ্বোধনকালে তিনি এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, এডিস মশা নিধনে সরকারের সব সংস্থাসহ দুই সিটি কর্পোরেশন ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে-ময়দানে কাজ করছে। শিগগিরই ভয়াবহ এডিস মশা থেকে পরিত্রাণ পাব। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থাকলেও তিনি সবসময় খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তাঁর নির্দেশ অনুসারে সবাই কাজ করছেন। 

চিকিত্সকরা ডেঙ্গু জ্বরে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি রোগীকে বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়াতে বলেছেন। এবার ডেঙ্গু জ্বরে রক্তের ঘনত্ব কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেওয়ায় আক্রান্তের রক্তচাপ কমে যাচ্ছে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে বলা হচ্ছে। জ্বর ভালো হওয়ার পরও ডেঙ্গুজনিত মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করছেন চিকিত্সকরা। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় তা প্রতিরোধে বাড়ির আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে বলা হচ্ছে। অফিস, ঘর ও আশপাশে যে কোনো পাত্রে (এসির ট্রে/ফুলের টব) জমে থাকা পানি তিন দিনের মধ্যে পরিবর্তন করতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায় বলে দিনে ঘুমানোর ক্ষেত্রেও মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।